ফিজিক্স অলিম্পিয়াডঃ যেভাবে প্রস্তুতি নেবে...
আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের অলিম্পিয়াডে ভালো না করার অন্যতম প্রধান কারণ সঠিক গাইড লাইন না পাওয়া। কি পড়ব, কোথাথেকে পড়ব, কিভাবে পড়ব; এসব প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে হাল ছেড়ে দেয় অনেকে। অনেকে আবার পিছিয়ে যায় লোকমুখে “পদার্থবিজ্ঞান কঠিন” শুনে। তবে প্রকৃত ফিজিক্স এর সাথে পরিচিত হলে তোমরা বুঝতে পারবে ফিজিক্স এর সৌন্দর্য। ছোট বয়স থেকেই প্রকৃত ফিজিক্স এর স্বাদ অনুভব করার সেরা মাধ্যম ফিজিক্স অলিম্পিয়াড।
ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তটা হতে পারে তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত। তোমরা যারা ভাবছো যে অলিম্পিয়াড করে কী হবে, তারা অলিম্পিয়াড কেন? এই ব্লগটা পড়ে নাও আগে।
ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের জন্য পড়াশোনা করার আগে একটু জেনে নাও বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কীভাবে কাজ করে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দল কীভাবে সিলেকশন করা হয়। সামনের পথটা কেমন হবে আগে থেকে জানা থাকলে তোমার প্রস্তুতি নিতেও অনেক সুবিধা হবে।
ফিজিক্স অলিম্পিয়াড যেভাবে কাজ করে...
ফিজিক্স অলিম্পিয়াড এর প্রথম ধাপটিই হলো আঞ্চলিক ফিজিক্স অলিম্পিয়াড।
এখানে প্রতিযোগিরা ভাগ হয় ৩টি ক্যাটাগরিতে। যে বছরের অলিম্পিয়াড আয়োজিত হচ্ছে, সে বছরের (উল্লেখ্য, X সালের অলিম্পিয়াডের আঞ্চলিক পর্যায় অনেক সময় X-1 বছরের শেষের দিকে হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রেও ক্যাটাগরি ভাগ X সাল অনুযায়ী হবে)
ক্যাটাগরি এঃ ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্যাটাগরি এ;
ক্যাটাগরি বিঃ ৮ম ও ৯ম শ্রেণি নিয়ে ক্যাটাগরি বি এবং,
ক্যাটাগরি সিঃ ১০ম, ১১শ ও ১২শ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অংশ নেয় ক্যাটাগরি সি তে। (২০২১ সালে অলিম্পিয়াডের নিয়মানুযায়ী, ১২শ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে আগের বছর অন্তত আঞ্চলিক পর্যায়ে বিজয়ী হতে হবে।)
সারাদেশে বছরভেদে প্রায় ১০-১৫ টি অঞ্চলে আয়োজিত হয় ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের আঞ্চলিক পর্ব। ২০২১ সালের অলিম্পিয়াড করোনা মহামারীর কারণে সকল পর্যায় অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। আঞ্চলিক পর্যায়ের সার্কুলারের জন্য বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে নজর রাখবে।
এরপর আঞ্চলিক পর্যায়ের বিজয়ীরা অংশগ্রহণ করে জাতীয় পর্যায়ে। জাতীয় পর্যায়ের আয়োজন হয় সচরাচর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে। জাতীয় প্রতিযোগীতায় প্রতিটা ক্যাটাগরিতে আবার আরেকটি পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং প্রতি ক্যাটাগরি থেকে গড়ে ২০-৩০ জনকে বাছাই করা হয়। বি ও সি ক্যাটাগরির সবাইকে জাতীয় ক্যাম্পের জন্য ডাকা হয় (কখনো কখনো এ ক্যাটাগরির প্রথম ১০ জনকেও ডাকা হয়, তবে সেটা কমই ঘটে)।
ক্যাম্পে কোনো ক্যাটাগরিভাগ থাকে না। সব ক্যাটাগরির জাতীয় পর্যায়ের পদকপ্রাপ্তরা সেখানে একসাথে ক্লাস করে। ক্যাম্পে মূলত প্রবলেম সল্ভিং টেকনিক রপ্ত করানো শেখানো হয়, এবং ধরে নেওয়া হয় যে তুমি যথেষ্ট পরিমান থিওরি জানো। প্রতিদিনের ক্যাম্প শেষে বাড়ির জন্য প্রবলেম সেট দেওয়া হয়।
জাতীয় ক্যাম্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটা হচ্ছে APhO সিলেকশন টেস্ট। সিলেকশন টেস্টের প্রশ্ন অবশ্য বি ও সি ক্যাটাগরির জন্য আলাদা হয়। সিলেকশন টেস্টের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে মোট ৮ জনকে Asian Physics Olympiad (APhO) তে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সিলেক্ট করা হয়। একটা ব্যাপার একটু মাথায় রাখো, দ্বাদশ শ্রেণির ছেলেমেয়েরা এইচ.এস.সি পরীক্ষার কারণে APhO তে অংশগ্রহণ করতে পারে না; এজন্য APhO টীমে সি ক্যাটাগরি থেকে শুধুমাত্র ক্লাস এলেভেন এর ছেলেমেয়েদেরই নেওয়া হয়। আরো একটা বিষয় মাথায় রাখো, APhO টিমে সিলেকশন দেওয়ার সময় অনেকক্ষেত্রেই সিলেকশন টেস্টের ফলাফলের সাথে ন্যাশনাল রাউণ্ডের ফলাফলকেও বিবেচনা করা হয়। তাই APhO টিমে চান্স পাওয়ার জন্য তোমার উচিত হবে ন্যাশনালের ফলাফলটাকেও ভালো করা।
কেন APhO টীমে চান্স পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ?
APhO নিজেই খুবই নামী একটা প্রতিযোগীতা; অনেকে এটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ফিজিক্স পরীক্ষাগুলোর একটা বলে গণ্য করেন। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে APhO টীমে চান্স পাওয়ার তাৎপর্য একটু বেশি। বাংলাদেশ দলের হয়ে যদি কেউ International Physics Olympiad (IPhO) দলে অংশগ্রহণ করতে চায়, তবে তার পূর্বশর্ত হচ্ছে তাকে আগে অন্তত একবার APhO তে অংশগ্রহণ করতে হবে। আগে APhO তে অংশগ্রহণ না করলে তাকে সচরাচর IPhO টীমে নেওয়া হয় না। এজন্য ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে আসার পরপরই তোমাদের টার্গেট হওয়া উচিত যেভাবেই হোক APhO টীমে জায়গা করে নেওয়া।
ধরে নিলাম, তুমি APhO টীমে চান্স পেয়ে গেলে। এরপর শুরু হবে তোমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কিছু দিন। এরপর মে মাসের আগ পর্যন্ত APhO ক্যাম্প চলতে থাকবে। থিওরেটিক্যাল ও এক্সপেরিমেন্ট ক্যাম্পের সাথে তোমার সারাজীবনের স্মৃতি জড়িয়ে থাকবে। এর মাঝে যেকোনো সময় IPhO সিলেকশন টেস্ট হয়ে যাবে; ঐ বছরের IPhO দল নির্ধারণে এই পরীক্ষাটার সামান্য কিছুটা ভূমিকা থাকে। মে মাসের শুরুর দিকে APhO অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ দলের অনেকের জন্যই APhO অনেকগুলো প্রথম– প্রথম দেশের বাইরে যাওয়া, প্রথম বিমানে চড়া, এবং যেটা অবশ্যই– প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা।
APhO তে তোমার পারফর্মেন্স কেমন হল সেটার ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে তুমি ঐ বছরে IPhO তে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না। IPhO প্রতিবছর জুলাই মাসে হয়; অর্থাৎ, APhO র দুই মাস পরে। APhO কে একারণে IPhO এর জন্য প্রস্তুতি কন্টেস্টও বলা হয়। APhO থেকে দেশে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই IPhO টীম ঘোষণা হয়ে যায়। তারপর আবার IPhO টীমের থিওরেটিক্যাল এবং এক্সপেরিমেন্ট ক্যাম্প চলতে থাকে জুলাই মাস পর্যন্ত।
APhO আর IPhO নিয়ে আরেকটু কিছু বলা যেতে পারে। APhO তে প্রতিবছর ২৫ টার মত দেশ অংশ নেয় (বেশিরভাগই এশিয়ার দেশ; এর সাথে অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপ থেকে রোমানিয়া আসে)। IPhO তে সারাবিশ্ব থেকে ৯০ টার মত দেশ অংশ নেয়। IPhO কে সম্মানের দিক থেকে APhO এর চেয়ে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। IPhO এর মেডেলের মর্যাদা APhO এর চেয়ে বেশি হলেও, প্রতিযোগীতা হিসাবে APhO ই IPhO থেকে অনেক গুণ কঠিন। একারণে APhO তে মেডেল পাওয়াটাও খুব কঠিন। এই লেখাটা লেখার সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত IPhO তে অনেকগুলো মেডেল আসলেও, APhO তে এখনো একটি মেডেলও আসেনি। তোমরা যারা এই লেখাটা পড়ছো, আমরা আশা করবো তোমরা যেনো বাংলাদেশের হয়ে APhO তেও মেডেল অর্জন কর। এছাড়া বাংলাদেশের গণিত অলিম্পিয়াডে (IMO) স্বর্ণপদক থাকলেও IPhO তে এখনো নেই, আমরা আশা করবো তোমরা যেন বাংলাদেশের পক্ষে স্বর্ণপদক অর্জন করে আমাদেরকে গর্বিত করবে।
এতক্ষণে তোমরা সবাই আশা করি বুঝে গিয়েছো ফিজিক্স অলিম্পিয়াড কিভাবে কাজ করে এবং বাংলাদেশ দলের হয়ে APhO/IPhO তে মেডেল পাওয়ার জন্য তোমাকে কী কী ধাপ পাড়ি দিতে হবে। এবার চল কথা বলি সবকিছুর জন্য প্রস্তুতি নিবে কিভাবে।
প্রস্তুতি নেবে যেভাবে...
প্রথমত একটা জিনিস বোঝো যে, অন্য সব অলিম্পিয়াডের মতই ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতিও অনেক সময়সাপেক্ষ। আমরা অনেককেই চিনি যারা আঞ্চলিক পর্যায়ের এক সপ্তাহ আগে এসে জিজ্ঞাসা করে অলিম্পিয়াডের জন্য কীভাবে পড়াশোনা করা উচিত। সত্যি বলতে এভাবে কিছুই হয় না। অলিম্পিয়াডে ভালো কিছু করতে চাইলে তোমাকে অনেকদিন ধরে প্রস্তুতি নিতে হবে। সচরাচর একজন IPhO ব্রোঞ্জ মেডেলিস্টের একটা ব্রোঞ্জ মেডেলের জন্য দুই-তিন বছর ধরে অলিম্পিয়াডের জন্য খুব ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়। সিলভার/গোল্ড মেডেলিস্টদের জন্য এটা চার বছর পর্যন্ত হতে পারে (অবশ্যই এই সময়টা প্রত্যেকটা মেডেলিস্টের জন্য আলাদা; তবে সবার ক্ষেত্রেই অনেক লম্বা সময় ধরে প্রস্তুতির বিষয়টা সাধারণ)।এজন্য তুমি যখনি এই লেখাটা পড়ছো, এখনই বসে যাও প্রস্তুতির জন্য। আঞ্চলিকের আগে পড়াশোনা করে খুব বেশিদূর এগোতে পারবে না, তোমার উচিত হবে সারাবছর সবসময় প্রচুর পড়াশোনা করা এবং প্রবলেম সল্ভিং করা।
এবার আসো বলার চেষ্টা করি কোন ক্যাটাগরিতে কী কী পড়বে।
ক্যাটাগরি এ
এ ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীরা এখনো একাডেমিক্যালি পদার্থবিজ্ঞানের সাথে পরিচিত নয়। এই ক্যাটাগরিতে ভালো করতে হলে তাদের পদার্থবিজ্ঞানের সাথে অন্তত অল্প-সল্প পরিচিতি লাগবে। তাছাড়া দক্ষতা লাগবে গণিতে। এ পর্যায়ের বেশিরভাগ সমস্যাই ক্লাসে শেখানো গণিত দ্বারা সমাধান করা যায়। তবে তাই বলে শুধু গণিত নিয়ে বসে থাকলে কিন্তু চলবে না! তোমাদের উচিত ৯ম-১০ম শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান বইটি পড়ে দেখা। যদিও আমাদের ক্লাসের বই গুলো প্রবলেম সলভিং ভিত্তিক না, তাও এগুলো পড়ে তোমাদের ধারণা কিছুটা ক্লিয়ার হবে। এছাড়া, মূলত বীজগণিত ও জ্যামিতিতে ভালো দক্ষতা থাকতে হবে।
এখন থেকেই তোমাদের উচিত হবে ইংরেজি বই পড়ার অভ্যাস করার, কারণ পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে সুন্দর সুন্দর বইগুলোই যে ইংরেজিতে লেখা! সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জনের জন্য তোমরা Paul Zeitz এর The Art and Craft of Problem Solving বইটি পড়ে দেখতে পারো। বইটি মূলত গণিতের হলেও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জনে বইটি অসাধারণ। বইটির শেষের দিকে হাইয়ার ম্যাথামেটিক্স এর কিছু চ্যাপ্টার আছে। ওইগুলোও যে তোমাদের পড়ে শেষ করতে হবে এমন না! সমস্যা সমাধানের উপর লিখা প্রথম ৪টি অধ্যায় পড়ে দেখতে পারো।
এগুলো শেষ হয়ে গেলে বি ক্যাটাগরির জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দেবে অবশ্যই। বিশেষ করে ত্রিকোনোমিতি আর ক্যালকুলাস যদি এ ক্যাটাগরিতে শিখে ফেলতে পারো, তাহলে বি ক্যাটাগরির দৌড়ে অনেক এগিয়ে থাকবে। এর বাইরে খান একাডেমি থেকে পদার্থবিজ্ঞানের ভিডিওগুলো দেখা শুরু করে দেবে। এতে দুটো লাভঃ
(ক) ফিজিক্স শেখা
(খ) ইংরেজি রপ্ত করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অলিম্পিয়াডে ভালো করার জন্য ইংরেজি বই পড়ার একেবারেই কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া ইংরেজি ভিডিও লেকচার শুনে বোঝার ক্ষমতা থাকাটা খুবই জরুরি, তাহলে পরে তুমি এমআইটির ক্লাসের লেকচারগুলোও দেখতে পারবে ইউটিউব থেকে। ইংরেজি রপ্ত করার জন্য মাঝে মাঝে ইংরেজি গল্প-উপন্যাস বা পত্রিকাও পড়তে পারো।
ক্যাটাগরি বি
অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নেওয়ার আসল সময়ই হচ্ছে ক্যাটাগরি বি। বাংলাদেশের বেশিরভাগ IPhO মেডেলিস্টের অলিম্পিয়াডে যাত্রা শুরু ক্লাস নাইনে।
এই ক্যাটাগরি থেকেই মূলত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য বাছাই শুরু হয়। তাই এই ক্যাটাগরিতে প্রস্তুতিটাও একটু বিস্তর। এই ক্যাটাগরিতে ভালো করতে হলে দরকার হয় ফিজিক্স এর বিষয়গুলোতে পরিষ্কার ধারণা। এছাড়া প্রবলেম সলভিং স্কিল তো লাগবেই। প্রবলেম সল্ভিং এর জন্য বাংলাদেশের স্কুল কলেজের বইগুলো মোটেও উপযোগী নয়। একারণে অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি নিতে কেউ ভুল করেও উচ্চমাধ্যমিকের বই ঘাটাঘাটি করতে যেও না! তবে বর্তমান নাইন-টেনের বইটা বেশ ভালো। প্রস্তুতির শুরুতে সবার আগে নাইন-টেনের ফিজিক্স টেক্সটবুক্টা শেষ করে নেবে (যদি এখনো না করে থাকো)
ক্লাস ৯ থেকেই তোমাদের ইংরেজি বই পড়া শুরু করা উচিত।
সবার আগে যেই বইটা পড়বে সেটা হচ্ছে– Halliday, Resnick ও Krane এর রচিত Physics Part-1 ও 2। অনেকে এই বইটার বদলে Serway & Jewett এর লেখা Physics for Scientists and Engineers কিংবা Young ও Freedman এর University Physics বইটা পড়ে। এই তিনটা বইকে বলা যায় ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের টেক্সটবইয়ের মত। এই তিনটা বইয়ের যেকোনো একটা বই খুব ভালোমতো প্রবলেমসহ শেষ করে ফেলবে আগা-গোড়া। এতে একটু সময় লাগবে, তবে এই ধাপটা অপরিহার্য।
এর বাইরে আরেকটা বই আছে– সেটার নাম হচ্ছে Fundamentals of Physics by Halliday, Resnick and Walker। HRK Physics এর তুলনায় HRW Fundamentals of Physics এর প্রবলেম কালেকশন বেশি। তবে এই বইটা একটু বেশী সহজ বলে তোমাদের উচিত হবে আগের তিনটা বইয়ের একটা পড়া।
University Physics বইটিতেও অনেক ভালো প্রবলেম আছে। এছাড়া Physics for Scientists and Engineers by Serway and Jewett বইটিও চমৎকার। এই বইটি অনেকটা HRK ও University Physics এর সমষ্ঠি মতো। বইগুলো কন্টেন্ট এর দিক থেকে প্রায় সমান । আমি বলব তোমাদের উচিত প্রতিটি বই থেকে অন্তত একটা জানা বিষয় পড়ে দেখতে এরপর যে বইটা ভালো লাগবে সেটা পড়বে। সবগুলো বই ইন্টারনেটে পিডিএফ আকারে পাওয়া যায়। এই ওয়েবসাইটের PhO Material অংশেও এই বইগুলোর পিডিএফ দেওয়া আছে। এছাড়া ঢাকার নীলক্ষেত এ বইগুলোর হার্ডকপি পাওয়া যায়। তোমার উচিত হবে এই বইগুলো ভালোভাবে বুঝে বুঝে পড়া ও সমস্যা সমাধান করা। থিওরি পড়া অপেক্ষা প্রবলেম সল্ভিং এ বেশি সময় দিতে হবে। এই বইগুলো অলিম্পিয়াডের পাঠ্যবই এর মতো। শুধুমাত্র এই বইগুলো পড়েই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সিলেক্ট হয়েছে কিন্তু অনেকে!
তবে এই বইগুলো পড়তে গেলে ক্যাল্কুলাস এর জ্ঞান লাগে। ক্যাল্কুলাস শেখার জন্য আসলে ইন্টারমিডিয়েটের পাঠ্যবই মোটেও উপযোগী নয়। নিজে নিজে এ বইগুলো পড়ে ক্যাল্কুলাস শেখা দুষ্কর। ক্যাল্কুলাসের জন্য Quick Calculus by Kleepner and Ramsey বইটি পড়তে পারো। এছাড়া Calculus for Dummies by Mark Ryan বইটিও ভালো। ফিজিক্স এর জন্য ক্যাল্কুলাস গুরুত্বপূর্ণ হলেও ক্যাল্কুলাস আসলে গণিতের অনেক বড় একটা শাখা। যতটুকু দরকার, তার থেকে বেশি সময় ক্যাল্কুলাসের পেছনে দেওয়া একদমই উচিত হবেনা। শুধু ক্যাল্কুলাস নয়, গণিতের যেকোন বিষয় (যেমন ভেক্টর , বীজগণিত) করার সময় মনে রাখতে হবে, তোমার মূল উদ্দেশ্য ফিজিক্স , গণিত নয়। ক্যাল্কুলাস বাদেও ত্রিকোণোমিতি ও স্থানাংক জ্যামিতিতেও দক্ষতা দরকার হবে। এক্ষেত্রে সাধারণত ৯ম-১০ম শ্রেণিতে শেখানোটুকুই যথেষ্ঠ হয়। ক্যাল্কুলাস শেখার পর একটা জিনিসের কথা না বললেই না। Walter Lewin lectures on Physics. ইন্টারনেটে থাকা ফিজিক্স শেখার কনন্টের মধ্যে এটা অন্যতম সেরা। আমার মতে সবচেয়ে সেরা। এগুলো MIT Physics এর Undergraduate দের ক্লাসের ভিডিও হলেও Professor Lewin যেভাবে এগুলো উপস্থাপন করেছেন, তাতে ক্যাল্কুলাস জানা যেকেউ সহজেই ভিডিও গুলো দেখে বুঝতে পারবে।
HRK/PSE/UniPhy বইয়ের যেকোনো একটা পড়া শুরু করে দেওয়ার সাথে সাথে এই ওয়েবসাইটের PhO Materials পেজের গাইডলাইন ফলো করা শুরু করবে। PhO Materials পেজে প্রচুর প্রবলেম সেটের লিঙ্কও দেওয়া আছে। বই পড়ার সাথে সাথে সেগুলোও সমাধান করতে থাকবে। ক্যাটাগরি বি তে থাকতে থাকতেই চেষ্টা করবে APhO/IPhO প্রবলেম সল্ভ করার চেষ্টা করতে।
ক্যাটাগরি সি
প্রথমেই বলে নিবো, আসলে সি ক্যাটাগরির পড়ার বা প্রব্লেম সল্ভিং এর কোনো লিমিট নেই। বি ক্যাটাগরির জন্য যা যা বলা হল সেগুলো তো করবেই, এছাড়া যত বেশি পড়বে ও সমস্যা সমাধান করবে, তুমি ততটাই এডভান্টেজে থাকবে। অবশ্য তাই বলে যেকোনো বই পড়ে সময় নষ্ট করবে না। আমাদের সবারই সময় সীমিত। এই সীমিত সময়ের মধ্যে থেকে তোমাকে সর্বোচ্চটা বের করে আনতে হবে। যেকোন বই বা প্রব্লেম সেট শুরু করার আগে একটু জেনে নাও বইটির বা প্রব্লেম সেটটির মান কেমন।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার দলগুলোয় এ ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীদেরই প্রাধান্য একটু বেশি থাকে। এ ক্যাটাগরিতে ভালো করতে কেবল HRK/PSE/UniPhy ভালো দখল থাকলেই চলবেনা। প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা বই পড়তে হবে এবং প্রচুর প্রবলেম সল্ভ করতে হবে।
এখানেও আগের মতই আবারও বলছি, কীভাবে কোন বই পড়বে সেগুলো PhO Materials পেজে বলা আছে। সেগুলো পড়তে থাকবে আর প্রবলেমগুলো সল্ভ করতে থাকবে।
এছাড়াও আরেকটা কাজ করতে থাকবে। APhO Syllabus এবং IPhO Syllabus খুলে যেই টপিকগুলোতে তোমার দূর্বলতা সেগুলোতে বেশি করে পড়া এবং প্রবলেম সল্ভিং করতে থাকবে। সি ক্যাটাগরিতে থাকাকালীনই APhO/IPhO এর শেষ ২০ বছরের সব প্রশ্নের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানা হয়ে যাওয়া উচিত (থিওরেটিক্যাল এবং এক্সপেরিমেন্টাল দুই প্রশ্নের ব্যাপারেই)।
শেষ কথা...
ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে বাস্তবিকেই ভালো করতে চাইলে একজনের টার্গেট হওয়া উচিত প্রথমে তার নিজের ক্যাটাগরির পড়াগুলো শেষ করা ও পরবর্তী ক্যাটাগরির পড়াগুলোও পড়তে থাকা। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কোনো ক্যাটাগরির পড়া স্কিপ না করা। অনেকেই দেখা যায় HRK/PSE/UniPhy পড়ার জন্য বলা বইগুলো না পড়েই অন্য বইগুলো পড়া শুরু করে দেয়। এমনটা করা উচিত নয়। বেশিভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এরকমটা করলে ব্যাসিক কন্সেপ্ট পুরোপুরি ক্লিয়ার থাকেনা। তুমি যদি বি ক্যাটাগরিতেই অলিম্পিয়াড শুরু কর, তাহলে ক্যাটাগরি এ এর পড়াশোনা হয়তো স্কিপ করতে পারো, তবে বি ক্যাটাগরির পড়াগুলো স্কিপ করা চলবে না। যদি তুমি সি ক্যাটাগরিতে অলিম্পিয়াডের প্রিপারশন শুরু করো, সেক্ষেত্রেও আগে বি ক্যাটাগরির বইগুলো পড়ে আসা উচিত। এই লেখাটা পড়া শেষ হলে এই ব্লগটাও পড়ে ফেলতে পারোঃ Physics Olympiad Study Guidelines। এখানে একজন আইফো সিলভার মেডেলিস্ট তার অভিজ্ঞতা থেকে ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতির ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিয়েছে।
যেকোন কাজেই সফলতা লাভের জন্য প্রয়োজন হয় পরিশ্রমের। ফিজিক্স ও ব্যাতিক্রম না। কেবল অলিম্পিয়াডের আগে প্রিপারেশন নিয়ে ভালো করা সম্ভব না। পুরো বছর জুরেই প্রিপারেশন নিতে থাকতে হবে। অনেক বেশি প্রবলেম সল্ভ করতে হবে। ফিজিক্সে অনেক মজার মজার প্রবলেম আছে। তুমি যদি কোন প্রবলেম চেষ্টা না করে কেবল সলিউশন দেখে নাও, তাহলে হয়তো তুমি খুবই মজার একটা অভিজ্ঞতা মিস করে গেলে!
লিখেছেঃ গোলাম ইশতিয়াক; IPhO-2023 ও IPhO-2022 এ ব্রোঞ্জ পদক এবং IPhO-2021 ও IdPhO-2020 এ Honorable Mention জয়ী।