You are currently viewing Why Olympiad?
অলিম্পিয়াডে কেন আসবে?

“ভাইয়া, অলিম্পিয়াড করে কী হবে? এগুলো আমার কী কাজে আসবে?” এই প্রশ্নটা আমি অনেক বেশি পাই। 

সত্যি বলতে প্রশ্নটা বেশ যুক্তিসঙ্গতও। অলিম্পিয়াড অনেক বড় একটা সময়জুড়ে একটা লক্ষের দিকে লেগে থাকার প্রতিশ্রুতি। যখন কেউ ঠিকভাবে অলিম্পিয়াডের জন্য প্রস্তুতি নেয়, তখন আমরা সচারচর ধরে নেই যে সে জীবনের অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে ঐ কয়টা বছর অলিম্পিয়াডকে বেশি প্রাধান্য দেবে। তাই এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তোমাদের অবশ্যই অধিকার আছে এরকম প্রশ্ন করার। এবং আমরাও এই প্রশ্নটা করেছিলাম। আমরা অলিম্পিয়াডে সবসময়ই প্রশ্ন করার দক্ষতাটাকে খুব গুরুত্বসহকারে নেই। দুঃখজনকভাবে, অনেকে এটার খুব সুন্দর জবাবটা পায়, আবার অনেকে পায় না। যারা একবার বুঝে ফেলে ঠিক কি জন্যে অলিম্পিয়াডে আসবে, তাদেরকেই দেখা যায় পরবর্তীতে অলিম্পিয়াডে অনেক ভালো করতে। একারণে আমি এই লেখাটাতে অলিম্পিয়াড কেন করবে, তার খুব ভালো একটা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। 

তবে মনে রেখো, আমি নিজে শুধুমাত্র ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের সাথে যুক্ত ছিলাম একারণে আমি এই উত্তরটা ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের সাপেক্ষে দিতে পারবো।একারণে আমার প্রশ্নের উত্তর অনেকটা কেন ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে আসবে, তার উত্তর হবে।  

 

প্রতিযোগীতার চেয়ে অনেক বেশি কিছু...

তোমরা অলিম্পিয়াডকে মোটামুটি সবাই একটা প্রতিযোগীতা হিসেবেই জানো। এটা ভুল না। অলিম্পিয়াড একটা প্রতিযোগীতা। প্রতিযোগীতাটা আয়োজন করা হয় অলিম্পিয়াডে দেশের সেরা ছেলেমেয়েদেরকে বাছাই করে আন্তর্জাতিক দলে নেওয়ার জন্য। কিন্তু অলিম্পিয়াড আসলে প্রতিযোগীতার চেয়ে অনেক বড় কিছু। প্রত্যেকটা অলিম্পিয়াড একটা পরিবারের মত। তুমি যখন ন্যাশনাল পার করে ক্যাম্পে যাবে, তখন তুমি সাথে সাথে অলিম্পিয়াড পরিবারের একজন সদস্য হয়ে যাবে। 

অলিম্পিয়াডের সবচেয়ে ভালো ব্যাপারটা হচ্ছে এখানে চিন্তা করতে শেখানো হয়। আমরা বাংলাদেশের মুখস্থভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেরা চিন্তা ভাবনা করে সমস্যার সমাধান করতে শিখি। তুমি যদি স্কুল কলেজের পড়াশোনা নিয়ে ক্লান্ত হও(আমাদের সবার মত) তোমার জন্য খুব ভালো একটা প্লাটফর্ম হচ্ছে অলিম্পিয়াড। এদিক দিয়ে ভেবে দেখলে, বাংলাদেশের জন্য অলিম্পিয়াড অনেকটা বিকল্প শিক্ষা-ব্যবস্থা— এখানে সার্টিফিকেট বা মেডেল থাকলেও কেউ সেগুলোর জন্য আসে না, সবাই এখানে আসে নতুন কিছু জানতে এবং নিজে নিজে সমস্যা সমাধান করা শিখতে। আমাদের স্কুল-কলেজে তো এটা পুরো উলটো। কিছু বোঝো বা না বোঝো, খাতায় লিখে দিলেই কাজ হয়ে গেলো। এর সাথে প্রশ্ন করার তো সামান্য সুযোগটাও নেই। এমনকি প্রশ্ন করলে অনেকসময় শিক্ষকরাই খুব খারাপভাবে অপদস্থ করেন। তুমি যদি এগুলো সবকিছু নিয়ে খুব দুঃখে থাকো, তাহলে অলিম্পিয়াডই হয়ত হতে পারে তোমার মুক্তির পথ। এমনকি বাংলাদেশে বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই অলিম্পিয়াডে আসে স্কুল-কলেজের ভঙ্গুর শিক্ষাব্যাবস্থা থেকে একটা আশ্রয় পেতে।

একটা বিষয় মনে রেখো, যাদের অলিম্পিয়াডের পদকের ঝুলি সবচেয়ে বেশি ভারী, তারা কিন্তু কেউই পদকের লোভে  অলিম্পিয়াডে যায় না। তারা সবাই আসে ঐ বিষয়টার প্রতি তাদের ভালোবাসার কারণে, পদক পাওয়াটা সেই ভালোবাসার একটা বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তুমি যদি শুধু পদকের আশায় অলিম্পিয়াডে এসে থাকো, তাহলে কিন্তু মোটেও বেশি দূর যেতে পারবে না— হয়তো দু একবার ডিভিশনাল বা ন্যাশনাল টিকে যাবে, কিন্তু অতটুকুই। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই সেরকম কেউ নও। তোমার কাছ থেকে আমরা অনেক বেশি আশা করি। আর ঠিকমত পড়াশোনা করার নিয়ম জানার জন্যেই তো তুমি আমাদের ব্লগগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে দেখতে এসেছো। 

ব্লগগুলো ঘেঁটে দেখাটা তোমার প্রথম পদক্ষেপ-মাত্র। কিন্তু এটা প্রমাণ করে যে তুমি স্কুলের পড়াশোনার বাইরে অন্য কিছুতেও আগ্রহী, যেই গুণটা অলিম্পিয়াডের জন্য খুবই জরুরী।

অলিম্পিয়াডের মত একটা প্রগতিশীল পরিবারের সদস্য হতে পারাটা অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু তোমার পাওয়ার তালিকাটা কেবল শুরু এখানে। সেগুলো নিয়ে বলার আগে চল তোমাদের আরেকটা প্রশ্নগুলো উত্তর দিয়ে নেই।

কিন্তু ভাইয়া...স্কুল কলেজের পড়াশোনার কি হবে? এস.এস.সি, এইচ.এস.সি, এডমিশন এগুলো কে দেখবে?

আমি তোমার আশংকা বুঝতে পারি। 

একটা সময় আমরাও তোমার মতই ভাবতাম, কিন্তু অনেক পরে বুঝেছি আমাদের এই চিন্তাভাবনাগুলো আসলে বেশিরভাগটাই অমূলক। তোমার স্কুল কলেজের পড়াশোনার কি হবে এটা বলার আগে চল দেখে নেই যারা আগে অলিম্পিয়াড করেছিলো, তাদের এখন কী অবস্থা? তারা এখন কে কোথায় আছে? তাদের এইচ.এস.সি, এডমিশনের কি হয়েছিলো।  

এই ছবিটা আমার অনেক প্রিয় কারণ এই IPhO তেই বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে প্রথম সিলভার পায়। এটা International Physics Olympiad-2017, ইন্দোনেশিয়াতে তোলা। 

বামপাশের দুজন তাওসিফ আহসান আর আজমাঈন ইকতিদার(নামের বানানে ভুল হতে পারে) দুজনই এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মাঝের নিশাত ফাহমিদা প্রত্যাশা এখন আছে এম.আই.টি তে। তার ডানে আবরার আল শাদীদ আবির(নামের বানানে এখানেও ভুল হতে পারে) এর বুয়েট এডমিশনের র‍্যাঙ্ক ছিলো ৬৯ তম। আর সর্বডানে ফাহিম তাজওয়ার স্বচ্ছ, আমাদের রাজশাহীর সন্তান, বর্তমানে আছে বিশ্ববিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালিফোর্নিয়াতে। 

এই ধারা অন্যান্য বছরের IPhO গুলোর জন্যেও সত্যি। APhO-17,18 ও IPhO-18 টীমের ইরতিজা ইরাম এখন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। IPhO-18 এর একজন ছিলো IPhO-17 এর আবির, আর দুজন ছিলো জুনিয়র(তারা এখনো এডমিশন দেয় নি)। বাকিজন, তাহমিদ মোসাদ্দেক মাহিন, ঢাকা-বিশ্ববিদ্যালয়ের এডমিশনে খুবই ভালো ফলাফল করে এখন ওখানেই আছে। 

এতো গেলো মাত্র দুবছরের পরিসংখ্যান। তুমি যদি তারও আগের খোঁজ নাও, তাহলে আরো অসংখ্য উদাহরণ খুঁজে পাবে। IPhO-16 এর মুহাইমিনুল ইসলাম (ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়), ফাহিম তাজওয়ার স্বচ্ছ ঐ IPhO তেও ছিলো। IPhO-15 এর দিব্যতনয় ভট্টাচার্য (ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়), সুপান্থ রক্ষিত (কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়)। IPhO-14 এর মোহাম্মাদ ফাহিম তাজওয়ার (ফাহিম তাজওয়ার স্বচ্ছ, আর মোহাম্মাদ ফাহিম তাজও্য়ার ভিন্ন ব্যক্তি) এখন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে আমরা তো বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলিই নি। যাই হোক, এই তালিকাটা আরো অনেক লম্বা, আমি আরো অনেকজনকে নামে চিনলেও অত ভালোমত জানি না বলে তাদের নামগুলো লিখলাম না। কিন্তু আশা করি তোমরা বুঝতে পেরেছো যে অলিম্পিয়াড করলে পড়াশোনা খারাপ হবে এটা একেবারে ভুল কথা, বরং এর উল্টোটা সত্যি। 

আমি তো শুধু ফিজিক্স এর কথা বললাম। তুমি এরকম আরো অনেক লম্বা লম্বা তালিকা বাকি সব অলিম্পিয়াডের কাছ থেকেই খুঁজে পাবে। লিস্টগুলো সত্যিই দেখার মত! 

সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশটা সবার শেষে বলি... আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতা

এটা আসলেই বিশেষ কিছু। তোমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিনগুলোর একটা হতে পারে আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ। সাধারণত APhO/IPhO নয় অথবা দশ-দিন ব্যাপী চলে। অন্যান্যগুলোর ক্ষেত্রেও তাই। 

তুমি ভাবতে পারো, ওখানে মনে হয় নয় দশ দিন পুরোটাই ফিজিক্স বা ম্যাথ করানো হয়। একদম না! পরীক্ষা থাকে মাত্র দুইদিন, আর বাকি প্রত্যেকদিন যে শহরে পরীক্ষা হয়, সে শহরের আনাচে কানাচে সমস্ত জায়গা ঘুরিয়ে দেখানো হয়। ওখানকার বিখ্যাত জায়গাগুলো, স্কুল-কলেজ এগুলো তো আছেই। এশিয়ান ফিজিক্স অলিম্পিয়াড-২০১৮ এর বড় বড় পাহাড়ের গুহার মধ্যে দিয়ে নৌকায় করে যাওয়া, কিংবা এশিয়ান ফিজিক্স অলিম্পিয়াড-২০১৯ তে অস্ট্রেলিয়ার এডিলেডে ক্যাঙ্গারুকে মুখে তুলে খাওয়ানোর স্মৃতি আমার মনে এখনো সবসময় জ্বলে থাকে। আমার জীবনের সেরা মূহুর্তগুলোর অনেকগুলোই দুটো APhO তে। তোমরা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে আরো অনেক বেশি বার যেতে পারবে, তাহলে বোঝো তোমরা আরো কত কি দেখতে পারবে!

ছবিটার ক্যাঙ্গারুটা বাচ্চা। আরো বড় বড় ক্যাঙ্গারুর দেখাও আমরা পেয়েছিলাম। 

আমার বিদেশি বন্ধু এবং বান্ধবীদের কথা না বলে যদি কেন অলিম্পিয়াডে আসবে এই পোস্টটা শেষ করে দেই, তাহলে অনেক বড় অবিচার করা হবে। দুটো এশিয়ান ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে আমার অসংখ্য ছেলেমেয়ের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। এমনকি তাদের অনেকের সাথে আমার এখনো প্রায় প্রতিদিনই প্রায় যোগাযোগ করা হয়। অনেক কারণে এটা সাহায্য করে প্রতিটা কাজে। আমরা বাংলাদেশে বেড়ে ওঠায় আমাদের সবার চিন্তা-ভাবনা কাছাকাছি ধরণের হয়। কিন্তু অন্য দেশের সংস্কৃতি আলাদা বলে ওদের কাছ থেকে অনেক মজার মজার জিনিস শেখার আছে। 

আর ফিজিক্স শেখার কথা বলতে তো ভুলেই গেছিলাম। তুমি নতুন নতুন ছেলেমেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করলে ওদের দেশের ট্রেনিং ম্যাটেরিয়াল, নতুন বই সম্পর্কে জানতে পারবে। যেমন হ্যালিডে রেজনিকের বইয়ের বাইরে Physics for Scientists and Engineers (রিসোর্স পেজে দেখো বিস্তারিত আছে) বইটার ব্যাপারে আমি জানতাম না। ওটার ব্যাপারে প্রথম শুনি APhO-18 এ তাজিকিস্তান টীমের সাবিনা নামের এক মেয়ের কাছে। ও পরে IPhO-18 এ সিলভার পায়। ছবিটাতে যেই ছেলেটাকে দেখছো, ওর কাছ থেকে চাইনিজ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের প্রশ্নগুলো নেওয়া। এছাড়াও রিসোর্স পেজের অনেক-কিছুই আসলে আমার ভিয়েতনামিজ বন্ধু IPhO-17 গোল্ড মেডেলিস্ট, মিন, এর দেওয়া। এমনকি এই ওয়েবসাইটের প্রথম ব্লগটাও রোমানিয়ার আরিয়ানার লেখা(ওকারণেই ওটা ইংরেজিতে)। 

 তোমার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে কন্টাক্ট ট্যাবে যোগাযোগ করতে পারো। এছাড়াও পরের ওয়ার্কশপে তোমাকে আমন্ত্রণ দিয়ে রাখলাম। আমাদের ওয়ার্কশপে কখন কিভাবে আসবে সবকিছু হোমপেজে আর আর আমাদের ফেসবুক গ্রুপে পেয়ে যাবে।  

অলিম্পিয়াডে তোমার যাত্রা শুভ হোক সেই কামনা করি।  

লিখেছেঃ শেখ শাফায়াত;